ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত গবেষক ও শিল্পী শুভেন্দু মাইতির লোকসঙ্গীতের সুরমূর্ছনা আর অসুর বিনাশী সুর সবখানে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় জানিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা’২০১৪। তিন দিনব্যাপী উৎসবের তৃতীয় ও শেষ দিন ৩০ মার্চ রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে আয়োজিত হয় আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী শুভেন্দু মাইতির একক সঙ্গীত সন্ধ্যা। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটি আয়োজনের কথা থাকলেও ৩০ মার্চ সকালে জাদুঘরের চতুর্থ তলায় আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠান আয়োজন না করার অনুরোধ করলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তা শিল্পকলা একাডেমীতে স্থানান্তর করা হয়। এ জন্য অনুষ্ঠানের শুরুতে উদীচী’র পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশও করা হয়।
উদীচী’র সহ-সভাপতি হাবিবুল আলমের সঞ্চালনায় শুরু হয় শুভেন্দু মাইতির একক সঙ্গীত সন্ধ্যা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই শিল্পীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান উদীচী’র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচী’র কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী। স্বাগত বক্তব্যের পর শুভেন্দু মাইতির সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন উদীচী’র কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন।
এরপরই শুরু হয় শুভেন্দু মাইতির সঙ্গীত পরিবেশন পর্ব। গণসঙ্গীত উৎসবে এসে মূলত গণসঙ্গীত দিযেই নিজের গানের ডালি সাজান শুভেন্দু মাইতি। তিনি শুরু করেন “অনেক শহর গ্রাম ছাড়িয়ে, অনেক দূর সে গ্রাম” গানটি দিয়ে। এরপর একটি কবিতা আবৃত্তি করে পরিবেশন করেন “বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়ে দাঁত কেন বান্ধাইলি” গানটি। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও ইতিহাসের নানা পর্যায়ের গণসঙ্গীত পরিক্ষেশন করেন শুভেন্দু মাইতি। তাঁর অনবদ্য পরিবেশনা ও শিক্ষনীয় উপস্থাপন ভঙ্গি মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ ও বিমোহিত করে।
ভারতের পূর্ব মেদিনীপুরের নান্দীগ্রামে জন্ম নেয়া শুভেন্দু মাইতি কৈশোর থেকেই গানের ভুবনে পা রাখেন। তাঁর গানের প্রথম গুরু মাসীর বাড়ির কলের গান ও বাড়ির এরিয়াল লাগানো রেডিও। পরবর্তীকালে লোকগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রায় পায়ে হেঁটে পশ্চিমবাংলার ১৯ জেলায় ঘুরে বেড়ান গানের খোঁজে। পাশাপাশি ত্রিপুরা ও আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বেরাক উপত্যকায়ও গেছেন তিনি। একটু একটু করে লোকগান ও লোক শিল্পীদের আপনজন হয়ে উঠেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় ১৬ বছর।
কৃষক সভার সদস্য হিসাবে ১৯৬৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে উঠে আসেন শুভেন্দু মাইতি। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পীসংঘ ও পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের রাজ্যস্তরের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। একজন ব্যক্তি-শিল্পী হিসেবে উত্থান নয়, বরং সংগঠক সত্তাকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সারাজীবন। তাঁর সমগ্র জীবনের অর্জনটুকুকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ২০০২ সালে গড়ে তোলেন ‘লালন আকাদেমি’। এই প্রতিষ্ঠানটি এই মুহূর্তে ভারতের একটি অগ্রগণ্য লোকসংস্কৃতি গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। লুপ্তপ্রায় লোকগানের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, চর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ নিষ্ঠার সাথে করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান।
’৯০ এর দশকের শুরুতে সুমন, নচিকেতা, লোপা, অঞ্জন, রাঘব, তপনদের হাত ধরে বাংলা গানের যে নতুন নাগরিক প্রবাহ আসে, তার ভগীরথ শুভেন্দু মাইতি। তিনিই এঁদের খুঁজে বের করেন ও এইচএমভি-র সহায়তায় পরিচিতির জগতে আনেন। অনেক জনপ্রিয় গণসঙ্গীতের স্রষ্টা শুভেন্দু মাইতি। পুরানো কাঠামো ভেঙ্গে গণসঙ্গীতকে কালোপযোগী নতুন রূপ দেয়ার পথ খুঁজেছেন সারাজীবন। গণসঙ্গীতের মাধ্যমে গ্রাম ও নগরের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন করতে চেয়েছেন তিনি। তিনি একাধারে নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। বহুরূপী, সায়ক, সমীক্ষণ, নকসা, শিল্পায়ন, ঋত্বিক, রঙ্গকর্মী প্রভৃতি পশ্চিমবাংলার অগ্রগণ্য নাট্যদলগুলোর সাথে তিনি কাজ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নাট্য আকাদেমি তাঁকে দু’বার শ্রেষ্ঠ নাট্যসঙ্গীত পরিচালকের সম্মান দিয়েছেন। সেই শুভেন্দু মাইতির অসামান্য পরিবেশনা ও অনবদ্য উপস্থাপনার মাধ্যমেই শেষ হয় উদীচী আয়োজিত তিন দিনব্যাপী সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা।
এর আগে, “অসুর বিনাশী সুরের আগুন, ছড়িয়ে দাও সবখানে”- এই শ্লোগান নিয়ে গত ২৮ মার্চ শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শুরু হয় উদীচী আয়োজিত “সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা’২০১৪”। উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী কামরুদ্দিন আবসার। এসময় উদীচী’র শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন উৎসবের উদ্বোধক কামরুদ্দিন আবসার এবং উদীচী’র পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী। উদ্বোধনের আগে সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পর্যায়ের গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা। জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা শেষে দেশের আটটি বিভাগীয় পর্যায়ের (ঢাকা পূর্ব ও পশ্চিমসহ) প্রতিযোগিতায় ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’Ñ এই তিনটি বিভাগের প্রথম তিনটি স্থানাধিকারীরা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে যুগ্মভাবে প্রথম হন শাহরিয়ার অভিক অতনু ও অর্ণব কান্তি সিংহ, দ্বিতীয় হন মীর মোবাশ্বিরা ইবনাত নদী, তৃতীয় স্থান পায় জিহাদ খান। ‘খ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন বিপ্লব রায়হান। যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হন আশরাফুল আলম এবং মানিক মোহন চন্দ। আর তৃতীয় হন নুশিন আদিবা ও জ্যোতিষ চন্দ্র বর্মণ। ‘গ’ অর্থাৎ দলীয় বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে উদীচী যশোর জেলা সংসদ। যৌথভাবে দ্বিতীয় হয় উদীচী চট্টগ্রাম, নওগাঁ এবং সিলেট জেলা সংসদ। তৃতীয় স্থান অর্জন করে তিনটি দল। এরা হলো- রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ, সাউন্ড টাচ রংপুর এবং অগ্নিবীণা শিল্পকলা বিদ্যালয়।
২৯ মার্চ শনিবার ছিল উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এ দিন বিকাল সাড়ে ৫টায় শুরু হয় আলোচনা সভা। উদীচী’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসব প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক ও উদীচী’র সহ-সভাপতি শংকর সাঁওজাল এবং উদীচী’র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। আলোচনা সভায় উদীচী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সাবেক সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদু, উৎসবের আমন্ত্রিত অতিথি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত গবেষক ও শিল্পী শুভেন্দু মাইতি, উদীচী’র সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম, কাজী মোহাম্মদ শীশ এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য সিদ্দিক মোল্লা অংশ নেন।
আলোচনা সভার পর চারণ শিল্পী ও উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের অন্যতম সদস্য সিদ্দিক মোল্লার গানের সিডি “গরীব দুঃখীর আপন কেহ নাই”-এর মোড়ক উন্মোচন করেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু ও শুভেন্দু মাইতি। উদীচী’র সাথে সম্পৃক্ত থেকে দীর্ঘদিন ধরে গণমানুষের সুখ-দুঃখের গান পরিবেশন করে আসছেন রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক মোল্লা। সমাজের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের এ প্রতিনিধি সবসময়ই উদীচী’র আদর্শে অণুপ্রাণিত হয়ে একটি শোষণমুক্ত, সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে লড়াই করে যাচ্ছেন। সিডির মোট ১৩টি গানের মধ্যে ১০টিরই কথা ও সুর দিয়েছেন সিদ্দিক মোল্লা। বাকি গানগুলোর মধ্যে একটির রচয়িতা উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেন এবং অন্যটির রচয়িতা উদীচী’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম। সিদ্দিক মোল্লার গানের সিডির মোড়ক উন্মোচনের পর সত্যেন সেন জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে সনদপত্র ও ক্রেস্ট তুলে দেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয় পর্বে একক গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী শুভেন্দু মাইতি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ, কফিল আহমেদ ও নবনীতা তপু। এছাড়াও, দলীয় গণসঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচী কাফরুল শাখা, বহ্নিশিখা ও সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন। উৎসবের প্রথম দু’দিন ছিল গত চারটি গণসঙ্গীত উৎসবের উল্লেখযোগ্য ছবি নিয়ে ‘আলোকচিত্র প্রদর্শনী’।
দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে গণসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দেয়া এবং গণসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেনের জন্মদিবস উপলক্ষে প্রতিবছর “সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা” আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্র, শ্রমজীবীর বিরুদ্ধে শোষক, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা, সত্যের বিরুদ্ধে অসত্য সর্বোপরি শুভ ও সুরের বিরুদ্ধে অশুভ ও অসুরের শক্তি দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাই, অশুভ আর অসুর শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সক্রিয় করার লক্ষ্যে উদীচী’র এবারের গণসঙ্গীত উৎসবের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়Ñ “অসুর বিনাশী সুরের আগুন, ছড়িয়ে দাও সবখানে”।