পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় ও অন্যান্য বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়াসহ অন্যান্য অসংগতির প্রতিবাদে এবং শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থীদের ষড়যন্ত্র বিস্তারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবীতে
প্রগতিশীল সংগঠন সমূহের পক্ষ থেকে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর
স্মারকলিপি
একটি জাতির অগ্রযাত্রার গতিপথ নির্মিত হয় সঠিক শিক্ষা-কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা-মনন-ব্যক্তিত্ব-চেতনা গড়ে তোলায় শৈশবের শিক্ষার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের চরিত্র গঠন ও বিকাশে প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বাল্যশিক্ষার মাধ্যমে শিশু চারপাশ চিনতে শিখে। বেশিরভাগ শিশুর শিক্ষার মূল জানালা তার বিদ্যালয় ও পাঠ্যপুস্তক। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতিসত্তার শিক্ষা সাধন এবং বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫, ১৬, ১৭, ১৯, ২৩, ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদে শিক্ষা সংক্রান্ত বিধানবলী উল্লেখ করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানই শিক্ষা বিষয়ক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ১৭ (ক) অনুচ্ছেদে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সকল শিক্ষার্থীকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতির ২- এর ধারায় মানবিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ৩-এর ধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা এবং ৭-এর ধারায় জাতি, ধর্ম, গোত্র ও নারীপুরুষের বৈষম্য দূর ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে আদিবাসীসহ সকল জাতিসত্তার জন্য স¦ স¦ মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলনই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। ২০১৭ সালের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে সকল শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে সরকারের সফলতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া পাঠ্যবইগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। ২০১৭ সালের পাঠ্যবইগুলোতে ছাপার ভুল, বানান-তথ্য-ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতি এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে মানুষের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। প্রাথমিকভাবে ঘটনাগুলোকে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হলেও, ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে এইসব বিকৃতির মূল কাহিনী। পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্য পুস্তকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে, তা গত কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট। এ বছরের পাঠ্যপুস্তক সেই সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপোষরফারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে যে ভুল ও তথ্য-ইতিহাস বিকৃতির ছড়াছড়ি, একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এটি তিন ধরনের। এক, বানান ও তথ্যগত বিকৃতি; দুই, বাক্য গঠনে ভুল; তিন, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটানো। এক ও দুই নম্বর ভুলগুলো সঠিক পরিকল্পনা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে হচ্ছে। কিন্তু তৃতীয় ভুলটি পরিকল্পিত এবং যারা করছেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি সাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্যে এই কাজটি করে চলছেন।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির “আনন্দপাঠ” নামের দুটি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নজরে আসে যে, হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী দুটি লেখা বাদ পড়েনি। তত দিনে ছাপা হয়ে গেছে প্রায় ১৫ লক্ষ বই। এরপর সেগুলো গুদামে রেখে ওই লেখা দুটি বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপানো হয়। এনসিটিবি সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যমতে, এই দুই শ্রেণিতে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ লাখ বই ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। বাকি বই ছাপা শুরু হয়েছিল বা বাঁধাইয়ে ছিল। মুদ্রাকরদের হিসাবে, ছাপা বা সাদা কাগজ কোনো কাজে আসবে না। শুধু অব্যবহৃত প্রচ্ছদ কাজে লেগেছে।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের লিখিত প্রস্তাবে মোট ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে এ দুটি লেখারও উল্লেখ ছিল। ২৭টি লেখা গ্রহণ ও বর্জন করা হলেও দেখা যায়, এই মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত থাকা অষ্টম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে সংকলিত উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ‘রামায়ণ-কাহিনি’ এবং সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘লালু’ গল্প বাদ দেয়া হয়নি। এরপর ছাপা বই বাতিল করা হয় এবং সংশোধনের পর নতুন করে ছাপা হয়। গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, প্রথমবার ছাপা সপ্তম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ বইটি ছিল ৬৬ পৃষ্ঠার; সূচিপত্র লেখা ছিল ১০টি। বর্তমানে ‘লালু’ গল্পটি বাদে বিনামূল্যে বিতরণকৃত বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬০; সূচিপত্র ৯টি। অষ্টম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ বইটি প্রথমবার ছিল ৭২ পৃষ্ঠার; সূচিপত্র ছিল ৮টি; পরবর্তীতে বিতরণকৃত পাঠ্যবইয়ে ‘রামায়ন-কাহিনি (আদিকা-)’ বাদ দিলে তার পৃষ্ঠা সংখ্যা হয় ৬৩; সূচিপত্র ৭টি। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালের ০৮ এপ্রিল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের ২১ জন কেন্দ্রীয় নেতা লিখিতভাবে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে এই দুটি গল্প প্রসঙ্গে তাদের মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা জানায়। অন্যদিকে, পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে হেফাজতে ইসলামের সুপারিশ মতে হুমায়ুন আজাদের কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে। এমনকি এই শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে যে তিনটি নতুন বিষয় যুক্ত করার দাবি করেছিল এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তা পূরণ করেছে। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’ এবং এস. ওয়াজেদ আলির ‘রাঁচি ভ্রমণ’ বাদ দেয়া হয়েছে। দেশের নতুন প্রজন্মকে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণায় মগজ ধোলাইয়ের কূট-পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হেফাজতে ইসলাম নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিল। তারা দাবি তুলেছিল এই শ্রেণির বইয়ের পাঁচটি লেখা তুলে নেবার, যা এনসিটিবি পূরণ করেছে। এই পাঁচটি লেখার মধ্যে ছিল- মঙ্গলকাব্যের ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’, বাউলদের ওপর লালন শাহের লেখা ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ এবং জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’। এরকম সবগুলো পাঠ্য পুস্তক বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, হেফাজতের সুপারিশ অনুযায়ী ১৭টি লেখা যুক্ত করা হয়েছে এবং বাদ দেয়া হয়েছে ১২টি লেখা। এই পরিবর্তনে হেফাজতসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল সন্তোষ প্রকাশ করে সম্প্রতি বিবৃতিও দিয়েছে।
আমাদের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে। পাঠ্যপুস্তককে বেছে নেয়া হয়েছে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে। ফলে ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ও একক ধর্মের যে বিস্তার ঘটানো হয়েছে, তার পেছনেও একটি রাজনীতি আছে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বিরাজিত ক্রমবর্ধমান পশ্চাৎপদতা ও সংকীর্ণ চেতনার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ ছিলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তার ফসল ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বিজয় আমরা ধরে রাখতে পারিনি। একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি আজ এতো বছরে আমাদের রাজনৈতিক মেরুদ-হীনতার সুযোগে এক বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ যখন ভুল আর বিকৃত তথ্যে ভরা সাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্যে সরকারকে হেফাজতে ইসলাম বা চরমোনাইয়ের পীর ধন্যবাদ জানায়, তখন স্পষ্ট হয়Ñ কতোটা দিকচিহ্নহীন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের তথাকথিত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো। মৌলবাদের সঙ্গে আপোষ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাজনীতির এই দরকষাকষিতে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের জাতির ভবিষ্যতকে। শিশুদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিষ এবং তার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি আগের মতোই ফণা তুলে প্রস্তুত হয়ে আছে তার বিষাক্ত ছোবল দেবার জন্যে। আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো গালভরা বক্তৃতা বিবৃতির আড়ালে একের পর এক আপোষ করে যাচ্ছে।
হাজার বছরের আবহমান অসাম্প্রদায়িক আর সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতিকে আজ পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে দেয়া হচ্ছে। সৃষ্টি করা হচ্ছে জাতিগত, ধর্মীয় আর নারী-পুরুষের ভেদ-বৈষম্য। এ চক্রান্ত পরিকল্পিত, কেননা বাঙালির সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের পূর্বশর্তই হলো গুণগত ও সঠিক শিক্ষা। শিক্ষা হলো সাংস্কৃতিক পুঁজি। যে ‘উন্নয়ন’- এর কথা বলে সামগ্রিক আপোস আর মৌলবাদের তোষণনীতিকে বৈধ করার অপচেষ্টা চলছে, সে উন্নয়ন কেবলই অবকাঠামোগত। কিন্তু শিশুর মননে যে সংস্কৃতির আলো পৌঁছানো প্রয়োজন, সে পথে একের পর এক ব্যারিকেড তৈরি করা হচ্ছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নৈতিক বোধের স্ফূরণ না ঘটিয়ে সেখানে তৈরি করা হচ্ছে বিভেদ আর সাম্প্রদায়িকতা। জঙ্গীবাদের যে ভয়াল রূপ আমরা দেখছি, তা যে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্মূল করা সম্ভব নয়Ñ এ কথা সকলেই মানবেন। এই ক্যান্সারের মতো জঙ্গীবাদকে দমনের জন্যে প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। একদিকে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতার চাষ করা হচ্ছে, অন্যদিকে শিশুর মনোজগতে প্রবেশ করাচ্ছে বিদ্বেষ আর বৈষম্যের বিষÑ এই শিশুরা বড়ো হয়েই বিভ্রান্ত পথে পা বাড়াতে পারে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকে তারা জিহাদ হিসেবে অভিহিত করতে পারে। কারণ শিশু বয়সেই তাদের মাঝে ভয়ানকভাবে সংক্রমিত করা হচ্ছে বৈষম্যের হেমলক।
এ অবস্থায় আমাদের দাবি হলোÑ
১. সাম্প্রদায়িক , বৈষম্যমূলক ও ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
২. সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি তোষণ বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে মানবিক মূল্যবোধ ও দেশাত্মচেতনা সম্পন্ন বিশ্বজনীন মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
৩. শিক্ষার্থীদের মনন উদ্বোধনের পথ রুদ্ধ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন আজাদসহ যে লেখকদের লেখাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে, সেগুলো সংযোজন করতে হবে।
৪. শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও বাংলা একাডেমির বানান বিধানের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, তা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে তুলছে। ফলে বাংলা বানানের বিষয়ে তারা একটি নৈরাজ্যের মধ্যে অবস্থান করছে। সৃষ্টিশীল সাহিত্য ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে এই অসামঞ্জস্যতা দূর করে একটি স্থিতিশীল বানান কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।
৬. পাঠ্যপুস্তকের নির্লজ্জ দলীয়করণ, ব্যক্তিস্তুতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে শিক্ষার অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব গ্রহণ করে কোনো রাজনৈতিক দল তার দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে না।
৭. দেশের শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে সংবিধানে উল্লিখিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, গণমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার জন্যে উপযোগি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
৮. পাঠ্যপুস্তক জামাতিকরণ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রেরণকারী গণমাধ্যমকর্মীদেরকে চরমোনাইয়ের পীর যে হুমকি দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকার নিজেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা বিরোধী বলে ঘোষণা করলেও এবং এর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চাকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বললেও, পাঠ্য পুস্তকে উল্লেখিত বিষয়ে তার স্ববিরোধীতার আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা অবিলম্বে নবীন শিক্ষার্থীদের সাম্প্রদায়িক ও কুপমন্ডুক হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে আধুনিক ও মানবিক একটি রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এ পাঠপুস্তকের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাদান বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছি। একইসাথে বিষয়টি তদন্ত করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবী জানাচ্ছি।
আন্দোলনকারীদের পক্ষে
১৮ মাঘ ১৪২৩
৩১ জানুয়ারি ২০১৭