শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে সহজপাঠের নামে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি, সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অপকৌশল, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়া, ধর্মান্ধতা ছড়ানোর চক্রান্তের প্রতিবাদ, ভুলে ভরা পাঠ্যবই প্রত্যাহার এবং এসব কর্মকা-ের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করেছে প্রগতিশীল গণসংগঠনসমূহ। গত ৩১ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে জমায়েত হয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। উদীচী সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি পাঠ করেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার। বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, শিশু ও গণসংগঠন এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, শিশুদের চরিত্র গঠন ও বিকাশে প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বেশিরভাগ শিশুর শিক্ষার মূল জানালা তার বিদ্যালয় ও পাঠ্যপুস্তক। সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতিসত্তার শিক্ষা সাধন এবং বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। একইসাথে জাতীয় শিক্ষানীতির ২-এর ধারায় মানবিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ৩-এর ধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা এবং ৭-এর ধারায় জাতি, ধর্ম, গোত্র ও নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলনই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। বক্তারা আরো বলেন, ২০১৭ সালের পাঠ্যবইগুলোতে ছাপার ভুল, বানান-তথ্য-ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতি এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঘটনাগুলোকে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হলেও, ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে এইসব বিকৃতির মূল কাহিনী। পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্য পুস্তকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে, তা গত কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট মন্তব্য করে বক্তারা বলেন, এ বছরের পাঠ্যপুস্তক সেই সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির সাথে সরকারের আপোষরফারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। হাজার বছরের আবহমান অসাম্প্রদায়িক আর সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতিকে পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে দিয়ে জাতিগত, ধর্মীয় আর নারী-পুরুষের ভেদ-বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা।
সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে রওয়ানা হন বিক্ষোভকারীরা। পথে হাইকোর্টের সামনে পুলিশ বাধা দিলেও তা উপেক্ষা করে মিছিলটি সচিবালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে, আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পাঁচজনের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেয়। তারা হলেন- উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জীবনানন্দ জয়ন্ত, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান সাগর এবং যুব ইউনিয়ন ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন।
স্মারকলিপিতে সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমূলক ও ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক প্রত্যাহার, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি তোষণ বন্ধ, শিক্ষার্থীদের মনন উদ্বোধনের পথ রুদ্ধ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন আজাদসহ যে লেখকদের লেখাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে, সেগুলো সংযোজন করা, শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও বাংলা একাডেমির বানান বিধানের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দূর করা, পাঠ্যপুস্তকের নির্লজ্জ দলীয়করণ, ব্যক্তিস্তুতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা, দেশের শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, গণমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার জন্যে উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা এবং পাঠ্যপুস্তক জামাতিকরণের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রেরণকারী গণমাধ্যমকর্মীদেরকে চরমোনাইয়ের পীর যে হুমকি দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। রাজধানীর পাশাপাশি একই সময়ে দেশের প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।