তনু হত্যার প্রতিবাদে ৫ এপ্রিল সারাদেশে সাংস্কৃতিক সমাবেশ
সঙ্গীতের সুরে মানুষ, স্বদেশ ও বিশ্ব জাগানোর প্রত্যয় নিয়ে শুরু হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত “সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা-২০১৬”। গত ০১ এপ্রিল শুক্রবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দু’দিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট লোকশিল্পী গৌরাঙ্গ আদিত্য, যিনি সুদীর্ঘ কাল ধরে হাটে-মাঠে-ঘাটে যাত্রাপালায় বিবেকের গান গেয়ে আসছেন। এছাড়া, এবছর আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বরেণ্য গণসঙ্গীত শিল্পী বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তী। উপস্থিত ছিলেন দেশের বরেণ্য ছড়াকার আখতার হুসেন, বর্ষীয়ান সাংবাদিক শুভ রহমান এবং উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন-এর স্নেহধন্য ও আত্মগোপন থাকাকালীন সময়ে তাঁর পরিচর্যাকারী আমেনা আক্তার। এছাড়াও দেশের অগ্রণি শিল্পী, সংগঠক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও এ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। এ পর্বে উদ্বোধনী পরিবেশনা হিসেবে রবিউল ইসলাম শশীর গ্রন্থনায় ‘সঙ্গীতে জাগো’ শীর্ষক গীতি-আলেখ্য পরিবেশন করেন উদীচী’র শিল্পী-কর্মীরা।
উদ্বোধনী পর্বে বক্তারা দেশের নানা সঙ্কট নিয়ে কথা বলেন। সম্প্রতি কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু’র হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন বক্তারা। তারা বলেন, সামরিক বা বেসামরিক যেকোন ব্যক্তিই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাক না কেন, তাকে বা তাদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান বক্তারা। উদ্বোধনী পর্বের সভাপতির বক্তব্যে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী আগামী ০৫ এপ্রিল তনু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও এর সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে উদীচীর পক্ষ থেকে সারাদেশে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় উদীচীর শাখা সংগঠনগুলো ওইদিন একযোগে এ কর্মসূচি পালন করবে।
উদ্বোধনী পর্বের পর সন্ধ্যায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা। এ পর্বের শুরুতেই গণসঙ্গীত পরিবেশন করে মৌলভীবাজার জেলা উদীচী পরিচালিত সঙ্গীত বিদ্যালয় ধ্র“বতারা সঙ্গীত একাডেমীর ক্ষুদে শিল্পীরা। তারা পরিবেশন করে “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়” এবং “কারখানাতে, ক্ষেত-খামারে” গান দু’টি। এরপর দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। এছাড়া, একক সঙ্গীত নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ, বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী সোহানা আহমেদ, উৎসবের উদ্বোধক লোকশিল্পী গৌরাঙ্গ আদিত্য, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত আমন্ত্রিত অতিথি গণসঙ্গীত শিল্পী বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তী, অংশুমান দত্ত চৌধুরী অঞ্জন প্রমূখ। এছাড়াও, একক সঙ্গীত পরিবেশন করে সত্যেন সেন জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তিনটি একক বিভাগ- ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ” বিভাগের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারীরা, যথাক্রমে নম্রতা বর্মণ, তিথি দাস ত্রপা এবং ঝুমা দত্ত। দলীয় পরিবেশন নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত ছিল স্ব-ভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্র।
উৎসব উদ্বোধনের আগে ০১ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতার শুরুতে উদীচী’র সহ-সভাপতি অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান সেলিম-এর সভাপতিত্বে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বে বিচারকদের পক্ষে আলোচনা করেন গণসঙ্গীত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী অধ্যাপক মতলুব আলী। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে বিচারক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ, বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম এবং সোহানা আহমেদ। প্রতিযোগিতায় তিনটি একক ও একটি দলীয়- মোট চারটি বিভাগে সারাদেশে জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারীরা অংশ নেন। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছে নম্রতা বর্মণ সেতু, দ্বিতীয় দেবান্বিতা বহ্নি এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছে রুবাইয়াত আশরাফ ইভান। ‘খ’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তিথি দাস ত্রপা, দ্বিতীয় হয়েছে নুসরাত জাহান ঊষা এবং তৃতীয় হয়েছে সৃজনী বসু। ‘গ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন ঝুমা দত্ত, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন জান্নাত তাসনোভা চৌধুরী স্মিতা এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছেন বিজয় চক্রবর্তী। এছাড়া, ‘ঘ’ অর্থাৎ দলীয় বিভাগে প্রথম স্থান পেয়েছে মৌলভীবাজার জেলা উদীচী পরিচালিত সঙ্গীত বিদ্যালয় ধ্র“বতারা সঙ্গীত একাডেমী। দ্বিতীয় হয়েছে উদীচী যশোর জেলা সংসদ এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে উদীচী মিরপুর শাখা। আগামীকাল ০২ এপ্রিল বিকেলে উৎসব মঞ্চে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী প্রতিযোগীদের সনদপত্র ও সম্মাননা প্রদান করা হবে। এছাড়া, আগামীকাল সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিকেল চারটা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেশের খ্যাতনামা গণসঙ্গীত দল ও একক শিল্পীদের পরিবেশনা রয়েছে।
দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে গণসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দেয়া, গণসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসার এবং গণসঙ্গীতকে সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেনের জন্মদিবস উপলক্ষে প্রতিবছর এই উৎসব আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এবার সপ্তমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে এ উৎসব ও প্রতিযোগিতা। এবারের উৎসবের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “মানুষ জাগাও, স্বদেশ জাগাও, বিশ্ব জাগাও সঙ্গীতে”। আগামী ০৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তনে আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথি শিল্পী বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তী’র দ্বৈত গণসঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন থাকবে।