সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার প্রত্যয় জানিয়ে যশোর হত্যাকাণ্ড দিবস-এর ১৭তম বার্ষিকী পালন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শির্ল্পীগোষ্ঠী। এ উপলক্ষে ওই নৃশংস হামলায় নিহত শহীদদের স্মরণে এবং হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে গত ০৬ মার্চ, রোববার বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আলোক প্রজ্বলন কর্মসূচি আয়োজন করে উদীচী। অনুষ্ঠানের শুরুতে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচীর শিল্পীরা। এরপর যশোর হত্যাকাণ্ডের শিকার শিল্পী-কর্মীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ, ঢাকা মহানগর সংসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণজাগরণ মঞ্চ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, মুক্তিশিখা এবং উদীচীর বিভিন্ন শাখা সংসদের নেতৃবৃন্দ।
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা সভা। এতে বক্তব্য রাখেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার, সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লাভলু, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান সাগর, উদীচী যশোর জেলা সংসদের সদস্য ইকরামুল কবির, উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন, সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার, সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আলোচনা পর্ব। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, নৃশংসতম যশোর হত্যাকাণ্ডের ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত তার কোন সুষ্ঠু বিচার হয়নি। এ মামলার সব ধরনের দুর্বলতা কাটিয়ে অবিলম্বে শিল্পী-কর্মীদের হত্যার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বোমা হামলার ঘটনার সঠিক পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান বক্তারা।
আলোচনা সভার পর শুরু হয় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ পর্যায়ে “যশোর হত্যাকাণ্ডের ১৭ বছর” শীর্ষক গীতি আলেখ্য পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এ আলেখ্যটি গ্রন্থনা করেছেন বিপ্লব রায়হান। এছাড়া, দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী মিরপুর শাখার শিল্পীরা। সবশেষে ১৯৯৯ সালে যশোর থেকে শুরু করে ২০০৫ সালের ০৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে বোমা হামলার ঘটনা পর্যন্ত উদীচীর রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল নিয়ে উদীচী কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগের প্রযোজনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্ষতচিহ্ন’-এর দৃশ্যায়ন হয়।
১৯৯৯ সালের ০৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে আয়োজিত বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে গভীর রাতে যখন হাজারো জনতা ও সংস্কৃতিকর্মী বাংলার আবহমান সংস্কৃতির ধারক বাউল গানের সুর মূর্ছনায় বিমোহিত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই বিকট শব্দে দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটে মঞ্চের নিচে আগে থেকে রেখে দেয়া বোমার। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চালানো ওই নৃশংস হামলায় প্রাণ হারান নূর ইসলাম, সন্ধ্যা রানী, রামকৃষ্ণ, তপন, বাবুল সূত্রধরসহ অন্তত ১০ জন শিল্পী-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। আহত হন দেড় শতাধিক শিল্পী-কর্মী ও সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ। মৌলবাদী অপশক্তির ঘৃণ্য হামলার শিকার সেসব সংস্কৃতি কর্মী এখনও পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে নিয়ে জীবন যাপন করছেন।