গোলাম মহিউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৮ সালে কুমিল্লা জেলার শ্রীপুর গ্রামে। তাঁর পিতা আকতারউজ্জামান কলকাতায় নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে পড়াশুনা করেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে ইউনিয়ন পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সাত ভাই এবং চার বোনের মধ্যে গোলাম মহিউদ্দিন দ্বিতীয় সন্তান। মেধা এবং অদম্য প্রতিভার কারণে গোলাম মহিউদ্দিন ৩য় শ্রেণীতে অধ্যয়নের পর ৫ম শ্রেণীতে প্রমোশন পান এবং ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাস করে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে বিএসসি-ইন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দেন এবং ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ফলাফলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেণীতে ৫ম স্থান অর্জন করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে এমএস এবং ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন-এর সাথে যুক্ত হন গোলাম মহিউদ্দিন।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর গোলাম মহিউদ্দিন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য অধিদপ্তরে প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এন্ড প্রোডাক্শন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঐ বিভাগে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রকৌশলী হলেও তিনি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর চিন্তাভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন বিভিন্ন সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনে, আলোচনায় এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে। ১৯৯৪ সালে গ্যাট-ডাঙ্কেল চুক্তির প্রাক্কালে তিনি ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের মেকানিক্যাল বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে সর্বপ্রথম এই চুক্তির অশুভ দিক তুলে ধরেন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে অশুভ শক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়েছে তখন তিনি বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ (জ্বালানি) আহরণ, বিদেশি বিনিয়োগ ও জাতীয় স্বার্থ বিষয়ক সেমিনারে বিদেশিদের জন্য তেল-গ্যাসের অংশীদারিত্ব চুক্তি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ-বিরোধী বিষয়গুলো উত্থাপন করেন। জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ নিয়ে তাঁর অনেক প্রবন্ধ মাসিক ‘শিক্ষাবার্তা’য় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তিনি বুয়েটের Directorate of Continuing Education -এর পরিচালক ছিলেন।
গ্রামবাসীর উদ্যোগে ও সহযোগিতায় ড. গোলাম মহিউদ্দিন নিজের এলাকায় মাঝিগাছাতে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের লোকজন এই স্কুলের নাম দেন তাঁর পিতা শিক্ষানুরাগী মো. আখতারুজ্জামানের নামে। ড. গোলাম মহিউদ্দিন আমৃত্যু সেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোলাম মহিউদ্দিনের পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন। যার কারণে ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর রাজাকার-পাকিস্তানি বাহিনী যৌথভাবে কুমিল্লায় তাঁদের মাস্টারবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় গোলাম মহিউদ্দিন চাঁদা সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন, উদীচী’র ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আফ্রো এশীয় গণ-সংহতি পরিষদেরও সদস্য ছিলেন।
ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ ২০০৫ কনভেনশনে ড. গোলাম মহিউদ্দিনকে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করেছে মরণোত্তর স্বর্ণপদক।