প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ

তনু হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও শাস্তির দাবিতে দেশব্যাপী উদীচীর সমাবেশ

কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার এবং এর সাথে জড়িত সবাইকে অবিলম্বে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে সারাদেশে একযোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে গত ০৫ এপ্রিল বিকাল সাড়ে চারটায় রাজধানীর শাহবাগে আয়োজিত হয় এ কর্মসূচি। সমাবেশের শুরুতে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন উদীচী’র শিল্পীরা। এরপর উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে শুরু হয় প্রতিবাদী সমাবেশ। শুরুতে বক্তব্য রাখেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান। এরপর একে একে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আকরামুল হক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান।

সমাবেশে বক্তারা, তনুসহ বাংলাদেশে সংঘটিত সকল ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। হত্যাকাণ্ডের দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তনুর মৃত্যুর সঠিক কারণ না জানতে পারা এবং প্রাথমিক তদন্তে ধর্ষণের আলামত খুঁজে না পাওয়ার জন্য তদন্তকারীদের ব্যর্থতাকে দায়ী করেন তারা। এছাড়া, তদন্তকাজে অস্বাভাবিক ধীরগতি এবং সময়ক্ষেপণের তীব্র নিন্দাও জানান তারা। বক্তারা বলেন, সামরিক বা বেসামরিক যে কেউ এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাক না কেন, অবিলম্বে তাকে বা তাদেরকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা নাহলে ভবিষ্যতে আরো অনেক তনু বা ইয়াসমিন বা পূর্ণিমারা এধরনের পাশবিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

প্রতিবাদী সমাবেশে বক্তারা তনু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ছাড়াও আসন্ন পহেলা বৈশাখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবকে ঘিরে সম্প্রতি সরকারের জারি করা নানা নির্দেশনার বিষয়েও কথা বলেন। প্রগতিশীল সচেতন মানুষ ও সংস্কৃতি কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে পহেলা বৈশাখে বিকট শব্দের ও বিদেশী অপসংস্কৃতির পরিচায়ক ভুভুজেলা বাঁশি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান তারা। তবে, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সময় নিয়ন্ত্রণ করা এবং মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ ব্যবহার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, বাংলা ও বাঙালির স্বতস্ফূর্ত ও প্রাণোচ্ছল উৎসবকে সময়ের ঘেরাটোপে বাঁধার এ অপচেষ্টা প্রকারান্তরে সংস্কৃতিবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তিকে উৎসাহিত করবে বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা। তাই, অবিলম্বে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। সমাবেশে উদীচী সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার বলেন, সময় নিয়ন্ত্রণের এ সিদ্ধান্ত না মেনে পহেলা বৈশাখে সাধারণত যেধরনের কর্মসূচি নেয়া হয়, সেই একই ধরনের কমসূচি পালন করবে উদীচীর বিভিন্ন জেলা ও শাখা সংসদের শিল্পী-কর্মীরা।

সভাপতির বক্তব্যে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী বলেন, পাকিস্তানি আমলেও আইয়ুব খান বা সামরিক শাসকরা অনেক চেষ্টা করেও বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে পারেনি। এছাড়া, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পর্যন্ত নানা শাসনামলে রবীন্দ্র শতবর্ষ অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সময়ে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় বাংলার সংস্কৃতি কর্মীদের নানা সাফল্যের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠানমালার সময় নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা সফল হবে না। এছাড়া, শুধুমাত্র চারুকলা ইনস্টিটিউট নয়, দেশের সমস্ত তরুণ মুখোশ পড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। এসময় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য উদীচী সকল জায়গায় আলাদা ব্রিগেড গড়ে তুলবে বলেও ঘোষণা দেন কামাল লোহানী। তনু হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের সচেতন চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হবে না। তাই, কালবিলম্ব না করে তনুর প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে সর্বশক্তি নিয়োগের জন্য আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি আহবান জানান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের পুলিশ বাহিনীর বীরোচিত ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি সকল অন্যায়-অবিচারের সঠিক তদন্ত ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহবান জানান।

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে এবং তনু হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে একক সঙ্গীত পরিক্ষেশন করেন বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী সোহানা আহমেদ। প্রতিবাদী পথনাটক পরিবেশন করেন উদীচী নাটক বিভাগ। এছাড়া, ‘রসময় স্বাধীনতা’ নামের পথনাটক পরিবেশন করেন প্রাচ্যনাট স্কুল অব অ্যাকটিং এন্ড ডিজাইন-এর নাট্যকর্মীরা। নাটকটির ভাবনা ও প্রয়োগ করেছেন এ.বি.এস জেম। এছাড়াও, ‘চিৎকার কর মেয়ে দেখি যতদূর গলা যায়’ গানটির সাথে প্রতিবাদী নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচী’র ঢাকা মহানগর সংসদের নৃত্যশিল্পীরা।

ঢাকা ছাড়া, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জেলা উপজেলায় উদীচীর উদ্যোগে একযোগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করা হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.