উদীচী’র ২৩ তম জাতীয় সম্মেলনের বিষয়ে সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের বক্তব্য

অধ্যাপক বদিউর রহমান
অধ্যাপক বদিউর রহমান

০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উদীচীর ২৩তম জাতীয় সম্মেলন প্রসঙ্গে আমার কথা

প্রিয় উদীচীর ভাইবোনেরা,
গত ০৬, ০৭ ও ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ‍উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ২৩ তম জাতীয় সম্মেলনের তৃতীয় বা সমাপনি দিনের নির্বাচনি অধিবেশনে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে আমার কথা-

উদীচীর জাতীয় সম্মেলন ঘিরে একটি ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আগে থেকেই আমাদের শঙ্কা ছিল। যার প্রতিফলন ঘটে সম্মেলনের বিষয়নির্বাচনি কমিটি গঠনের সময়। কেন্দ্রীয় সম্পাদকম-লি ও কেন্দ্রীয় সংসদ সভায় এমন একটি বিষয়নির্বাচনি কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে উদীচীর কর্মীদের যথাযথ প্রতিফলন হয়নি বলে আমার বিশ্বাস। সাংগঠনিক অধিবেশনের প্রথম দিন রাতভর (রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা) সেই বিষয়নির্বাচনি কমিটির সভায় একটি খসড়া কমিটির প্রস্তাব পাস করানো হয়।

সম্মেলনের শেষ দিন সাংগঠনিক অধিবেশনের নির্বাচনি পর্বে সভাপতিত্ব করেন বিষয়নির্বাচনি কমিটির আহ্বায়ক জনাব হাবিবুল আলম। অধিবেশনের শুরুতে সাধারণ প্রস্তাব, সাংগঠনিক প্রস্তাব, সম্মেলনের ঘোষণা ইত্যাদি বিষয় সহজেই নিষ্পত্তি হয়। এরপর নতুন কেন্দ্রীয় সংসদের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কমিটি উত্থাপনের পর সভাপতি নতুন নামের প্রস্তাব এবং কেউ নাম প্রত্যাহার করতে চান কিনা, তা জানতে চান। এসময় প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদের জন্য নতুন অনেকগুলো নাম প্রস্তাব করা হয়। সব নাম যাচাই-বাছাই শেষে সভাপতি, কেউ নাম প্রত্যাহার করতে চান কিনা তা জানানোর আহ্বান জানান। তখন অনেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেন। এমনকি বিষয়নির্বাচনি কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেল থেকেও অনেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন। ফলে, বিষয়নির্বাচনি কমিটির প্যানেলটি পূণতা হারায়। তা সত্ত্বেও, সভাপতি বিষয়নির্বাচনি কমিটির খ-িত প্যানেল পাস করানোর চেষ্টা চালান।

এ অবস্থায়, কাউন্সিল হাউজ ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। এই সময় আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সবাইকে শান্ত করার উদ্যোগ নেই এবং সভাপতি, হাবিবুল আলমের কাছে মাইক্রোফোন দেয়ার অনুরোধ জানাই। কিন্তু তিনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন এবং আমাকে মাইক দেননি। আমি বলেছিলাম, আমার এখনও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমি কাউন্সিলরদের শান্ত করার চেষ্টা করে দেখি। কিন্তু তিনি তা আমলে নেননি। ইতোমধ্যে ডায়াসের মাইকটিও সরিয়ে নেয়া হয়। আমি একবার কথা বলা শুরু করতে পেরেছিলাম। সাথেসাথেই হাবিবুল আলম আমার কাছ থেকে মাইকটি নিয়ে নেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি কথা বললে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতো। কিন্তু, আমি সেই সুযোগ না পেয়ে মঞ্চের ডান পাশে একটি চেয়ারে বসে পড়ি। দুয়েক মিনিট পর সম্মেলনের দুই জন স্বেচ্ছাসেবক নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে এবং আমাকে ভেতরে নিয়ে বসায়। সেখানে সেসময় আহত গাজীপুরের টঙ্গী শাখা সংসদের কর্মী, চামেলি আক্তার মনির শুশ্রুষা চলছিল।

তখন, দুজন স্বেচ্ছাসেবক আমাকে বলে যে, “আপনার এখানে একা থাকা ঝুঁকির্পূণ। আমরা আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই”। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও তাদের কথায় রাজি হয়ে আমি তাদের সাথে সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে সামনে আসি। এসময় আরো ১৫-২০ জন মানুষ আমাকে ঘিরে ধরে। আমি তাদের সাথে সামনে এগিয়ে যেতে থাকি। গেটের কাছে গেলে জামসেদ আনোয়ার তপন এসে আমার পাশে দাঁড়ান এবং বলেন, ”চলুন উদীচী অফিসে যাই“। এর মধ্যে দুয়েকজন বলে, “আমরা মিছিল করবো”। আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে না যাওয়ার কথা বললে বেশ কয়েকজন উত্তেজিত কর্মী আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে এবং একটি রিকশায় তুলে বসায়। তখন, রিকশা ও মিছিল সামনের দিকে এগোতে থাকে। আমার সাথে রিকশায় বসেন একজন হৃষ্টপুষ্ট কর্মী। তিনি আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। আমি যখনই তাকে কোন প্রশ্ন করেছি, তিনি বলেছেন যে, “আমরা উদীচী অফিসে যাবো”। এসময় রুমি দে নামের একজন কর্মী বারবার এসে রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং একটু কাছে থেকে তাকে সহায়তা করেন ইকবালুল হক খান। উদীচী অফিসের সামনে পৌঁছালে বেশ কয়েকজন আমাকে স্বাগত জানায় এবং ভেতরে যেতে বলে। আমি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দেয়ার জন্য পকেটে হাত দিলে তারা জোরে চিৎকার করে আদরের সুরে বলে, “আপনার ভাড়া দেয়া লাগবে না, আমরাই দিচ্ছি”। এসময় তাদের সাথে হেঁটে উদীচী অফিসের গেটের দিকে যেতে বাধ্য হই। গেটের নিচতলায় হাতের ডান পাশে চারটি কাঠের চেয়ার সাজানো ছিল। আমি সেখানে একটি চেয়ারে বসে পড়ি। সাথেসাথে জামসেদ আনোয়ার তপন আমার ডানদিকে এসে বসেন। তখন অসংখ্য মোবাইল ক্যামেরা আমাদের ছবি ধারণ করে। তখন আমি বলি, “আমার শরীরে কুলোচ্ছে না, আমাকে বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো”। তখন ওরা বলে, “না ওপরে চলুন”। আমি তাদের সাথে উদীচী কার্যালয়ে যাই। তারা আমাকে ডেস্কের মূল চেয়ারে বসার জন্য অনুরোধ করে। তবে আমি বলি, “আমি সামনের চেয়ারে বসি এবং এখানেই বসবো”। সেখানেই বসে পড়ি আমি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জামসেদ আনোয়ার তপন এসে আমার বাম পাশে বসেন। এসময় সামনে বসা ছিলেন হাবিবুল আলমসহ কয়েকজন। এক পর্যায়ে হাবিবুল আলম আমাকে বলেন, “আমরা আপনাকে মাথায় তুলে রাখবো”। বিষয়টি শুনে আমার হাসি পেয়েছে। এরপর আরিফ নূর, রহমান মুফিজ এসে জামসেদ আনোয়ার তপনকে বলতে থাকেন, “আমাদের নতুন কমিটির প্রথম সভা এখানেই করতে হবে”। জামসেদ আনোয়ার তপনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় আমি নিজের অবস্থান বুঝে ফেলি এবং সভা না করার কথা বলি। বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য তখন আমি নিজের অসুস্থতার কথা বলতে থাকি এবং হাবিবুল আলম ও জামসেদ আনোয়ার তপনকে কাছে টেনে আমার শারীরিক অবস্থার কথা বলে আমার কোন রকম দুঘটনা ঘটলে তার দায় সংগঠনকে নিতে হবে বলে জানাই। আমি এ-ও বলি যে, ”আমার মনে হয় এখনই হাসপাতালে যাওয়া উচিত, অ্যাম্বুলেন্স ডাকো”। পরক্ষণেই বলি, “আমি আগে বাসায় যাই, সেখানে প্রেসার ও সুগার মেপে প্রয়োজনে বাসা থেকেই হাসপাতালে যাবো”। তখন, হাবিবুল আলম দয়াপরবশ হয়ে তার ব্যক্তিগত গাড়িতে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেন। বাসায় পৌঁছে আমি মোবাইল বন্ধ করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

যথারীতি ভোরে আমার ঘুম ভাঙলে আমি আমার দায়বদ্ধতা ও কর্তব্যবোধের কারণে বিষয়টি সারাদেশের উদীচী কর্মীদের জানানোর তাগিদ অনুভব করি। তারই সূত্রে এই বার্তা। এদিকে জানতে পারি, সম্মেলন স্থলে উপস্থিত বেশিরভাগ প্রতিনিধি/পর্যবেক্ষক স্বাক্ষর দিয়ে একটি নতুন কেন্দ্রীয় সংসদ গঠন করেছেন। এ পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার জন্য সবাইকে বিনীত অনুরোধ জানাই। আমি আহ্বান জানাই, উদীচীতে যেন কোন ধরনের বিভাজন সৃষ্টি না হয়। একইসাথে সত্যেন সেন-রণেশ দাশগুপ্তের দেখানো পথেই সাংগঠনিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে উদীচীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সারাদেশের কর্মীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

সবাই ভালো থাকবেন। জয় উদীচী।

বদিউর রহমান
সভাপতি
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.