উদীচীর একাদশ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব সমাপ্ত

“প্রলয় বাজাও গানে, সাহস জাগাও প্রাণে”– এই শ্লোগান নিয়ে ১০ মার্চ শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বীর ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদীচীর একাদশ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার উৎসবের কার্যক্রম।

শুক্রবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদীচীর একাদশ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন উদীচীর অন্যতম উপদেষ্টা, বিশিষ্ট লোকশিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতি। এসময় সমবেতভাবে জাতীয় সঙ্গীত এবং উদীচীর সংগঠন সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।

১০, ১১ ও ১২ মার্চ তিনদিনব্যাপী উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল ১১ মার্চ শনিবার। এদিন, জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ীদের হাতে ফুল, ক্রেস্ট এবং সনদ তুলে দেন আমন্ত্রিত অতিথি এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের নেতৃবৃন্দ। এবারের প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত পর্বে ‘ক’ বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন নেত্রকোনার অপলা সাহা। দ্বিতীয় হয়েছেন বগুড়ার সৌমিকা লাহিড়ী। আর তৃতীয় স্থান পেয়েছেন নেত্রকোনার আইরিন জাহান পলি। ‘খ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন মৌলভীবাজারের তনুশ্রী পাল শ্রেয়া। দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন সিরাজগঞ্জের আনন্দ কুমার দাস। তৃতীয় হয়েছেন দিনাজপুরের বর্ণমালা ইসলাম প্রজ্ঞা।

‘গ’ বিভাগে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয়েছেন রাজবাড়ীর মো. আওয়াল মোল্লা, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন যশোরের মুস্তাহীদ হাসান এবং তৃতীয় হয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের অরুণ চন্দ্র বর্মণ। এছাড়া, ‘ঘ’ অর্থাৎ দলীয় বিভাগে সেরা হয়েছে উদীচী নোয়াখালী জেলা সংসদ। দ্বিতীয় হয়েছে যুগ্মভাবে উদীচী মাদারীপুর জেলা সংসদ এবং মৌলভীবাজার জেলা সংসদ। আর তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে বরিশালের উত্তরণ সাংস্কৃতিক সংগঠন।

উৎসবের প্রথম দুই দিনই সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছিল দেশবরেণ্য গণসঙ্গীত শিল্পী ও দলের পরিবেশনা। এবারের উৎসবের সহযোগিতায় রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। এবারের গণসঙ্গীত উৎসবের প্রথম দিন সন্ধ্যায় সত্যেন সেন রচিত গান নিয়ে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি জামসেদ আনোয়ার তপন-এর গ্রন্থনা ও হাবিবুল আলম-এর নির্দেশনায় উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ পরিবেশন করে আলেখ্য “অপরাজেয় গণশিল্পী সত্যেন সেন”।

উৎসবের তৃতীয় ও শেষ দিন ১২ মার্চ রোববার ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তিন প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী কঙ্কন ভট্টচার্য্য, মন্দিরা ভট্টাচার্য্য ও রঞ্জিনী ভট্টাচার্য্যের সঙ্গীত সন্ধ্যা। তাদের সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হন মিলনায়তন ভর্তি দর্শক। লোকসঙ্গীত, বিদেশি গানের অনুবাদ আর নিজেদের লেখা ও সুর করা মৌলিক গানের সমন্বয়ে অনবদ্য একটি সঙ্গীত সন্ধ্যা উপহার দেন এই শিল্পী পরিবার। আর এমন অসামান্য আয়োজনের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত একাদশ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার।

এদিন সন্ধ্যা ৭টায় ছায়ানট মিলনায়তনে শুরু হয় এবারের উৎসবের আমন্ত্রিত শিল্পী কঙ্কন ভট্টচার্য্য, মন্দিরা ভট্টাচার্য্য ও রঞ্জিনী ভট্টাচার্য্যের ত্রয়ী সঙ্গীত সন্ধ্যা। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান-এর সভাপতিত্বে আয়োজনের শুরুতেই শিল্পীদের মঞ্চে আহ্বান করেন সঞ্চালক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন। এরপর তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুরাইয়া পারভীন। শিল্পীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। আর, উৎসব স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট তুলে দেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। এছাড়া, উপহার ও বই তুলে দেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি হাবিবুল আলম এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান। এরপর শিল্পীদের প্রতি উদীচীর প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হালিমা নূর পাপন।

শুরুর আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় শিল্পী ত্রয়ীর সঙ্গীত পরিবেশনা। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীত, পল রবসন বা পিট সিগার-এর বিপ্লবী গানের অনুবাদ, চিলির গণজাগরণমূলক গানের অনুবাদ কিংবা বাংলার নিবারণ পণ্ডিত-এর গান— কী ছিল না সেখানে। গানে গানেই যেন পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করেন কঙ্কন, মন্দিরা এবং রঞ্জিনী। সাথে ভ্রমণ করান মিলনায়তনে উপস্থিত শ্রোতাদেরকেও। এছাড়া, নিজেদের লেখা ও সুর করা প্রখ্যাত সব গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন তিন শিল্পী। ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ এবং সলিল চৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস-এর সৃষ্ট কিংবদন্তি সব গানও। তাদের একেকটি অনবদ্য পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন শ্রোতারা। পান অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নতুন অনুপ্রেরণা।

গণসঙ্গীতের প্রচার, প্রসার এবং একে একটি স্বতন্ত্র সঙ্গীতের ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রতিবছর উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন-এর জন্মদিন ২৮ মার্চকে কেন্দ্র করে এ উৎসব ও প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.