বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র উনবিংশ জাতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে সংবাদ সম্মেলন
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের পক্ষ থেকে আপনাদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। “নিত্য বাজুক বজ্রবীণা, মানুষ জাগুক জয়ে”- এই শ্লোগানকে ধারণ করে আগামী ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঊনবিংশ জাতীয় সম্মেলন। আপনারা জানেন, গত বছর প্রথম সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে ‘একুশে পদক’ লাভ করে উদীচী। এই পদক মানুষের প্রতি, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে আমরা মনে করি। তাই, এবারের সম্মেলন আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রিয় বন্ধুরা, বর্তমানে ঘটনা দুর্ঘটনা এই দুর্ভাগা জাতির নিত্য দিনের সাথী হিসেবে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবন ট্রাজেডি এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশের মানুষের মনে। তেলভর্তি জাহাজ ডুবে গিয়ে পুরো সুন্দরবন আচ্ছাদিত হয়ে পড়ায় এ বনকে ঘিরে হাজারো প্রজাতির প্রাণী আর মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে আকাশ বাতাস। বনের পাশেই কয়লা ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা অব্যাহত থাকায় ভবিষ্যতে এধরনের আরো অনেক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলাকারী তেল আর কয়লাবাহী জাহাজ থেকে নির্গত বর্জ্য দূষিত করবে নদীর জল, ভেসে উঠবে বিরল প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন আর প্রায় বিলীন হওয়া কচ্ছপ-কুমিরের মৃতদেহ। ক্রমেই বিলীন হবে জলজ আর বনজ প্রাণী, উজাড় হবে সুন্দরবন। আমরা এ অশুভ চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
প্রিয় বন্ধুগণ,
দেশব্যাপী ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং ধর্মের নামে ব্যবসার কারণে তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছে। ওয়াজের নামে এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত করছে নারীদের, যা শুনে বলীয়ান হয়ে উম্মত্ত যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, গার্মেন্টস কারখানাগামী নারীদের উপর। ধর্ম যেখানে মানুষকে শান্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা, মানবতার বাণী শোনানোর কথা, সেখানে দেশে দেশে আজ ধর্মের নামে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে ধর্মীয় জঙ্গিরা। যে তরুণেরা একাত্তরে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এদেশের মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য, তাদের হাতেই আজ লাঞ্ছিত হচ্ছে মা-বোনেরা। যুব সমাজের সামনে এখন মডেল হচ্ছে দুর্বৃত্ত, লুটেরারা। মাদক চোরাচালানের গডফাদাররা জাতীয় সংসদের আসন দখল করে রেখেছে। এই লুটেরাদের প্রতিনিধিরাই শাসন ক্ষমতায় পালাবদল করে আসছে। জনগণ একবার এর দিকে একবার ওর দিকে ঝুঁকছে।
প্রিয় বন্ধুরা,
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজের ফলাফল আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের চূড়ান্ত রায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে। তবে, রায় কার্যকরের গতি একেবারেই স্থবির। শুধুমাত্র কাদের মোল্লা ছাড়া এখনও পর্যন্ত আর কোন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করা হয়নি। রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গত বছর তরুণ প্রজন্মের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণে সংঘটিত গণজাগরণ আন্দোলনে উদীচী প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই আন্দোলন যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে আমরা মনে করি। তবে, বিচারের রায় কার্যকরে দীর্ঘসূত্রিতা ন্যয় বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মানুষের মনে আবারো সংশয় সৃষ্টি করেছে। আমরা অবিলম্বে সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকরের জোর দাবি জানাই।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
একটি রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে উদীচী দেশের সার্বিক এ অবস্থা মেনে নিতে পারে না। বৈষম্যমূলক ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির হাত থেকে দেশ, মানুষ ও সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন এমন এক ব্যবস্থা সৃষ্টির যা মানুষকে মানুষের মর্যাদায় আসীন করবে। লাখো শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে যে সমাজের আকাঙ্খা মূর্ত হয়ে উঠেছিল সেই অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এ কাজটি প্রধানত রাজনৈতিক দলের। যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমাগতভাবে শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে বাংলাদেশের আদর্শকে বিভ্রান্ত করেছে তাদের পরাভূত করেই নতুন শক্তির প্রতিষ্ঠা হবে। এই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের জন্য দেশের মানুষের মনোজগত তৈরি করাটাই সবচেয়ে প্রধান কাজ। আর, এখানেই সংস্কৃতি কর্মীদের দায়িত্বের প্রশ্ন। যে সাংস্কৃতিক চেতনার দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করে এদেশের মানুষ অতীতে অগণতান্ত্রিক শাসক শোষকদের ভিত উপড়ে ফেলেছিল, আজ সে ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্তব্য আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। মানুষকে সচেতন ও আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গান, নাটক, কবিতা, সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র নিয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে। উদীচীর শাখা ও জেলা সম্মেলনসমূহে এ কর্তব্যের কথাই বারবার আলোচিত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সাংস্কৃতিক তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ এসেছে আলোচনায়। জাতীয় সম্মেলনে সেই তাগিদ আরো বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হবে। চলমান নানামাত্রিক সামাজিক সমস্যা-সঙ্কট, অসামঞ্জস্যতা, অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং নিরন্তর লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে জয়লাভ করার প্রত্যয়ে উদীচীর এবারের সম্মেলনের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- “নিত্য বাজুক বজ্রবীণা, মানুষ জাগুক জয়ে”।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
আগামী ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর লড়াই, সংগ্রাম ও গণসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক-বাহক সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঊনবিংশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ২৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন ২০০৫ সালে নেত্রকোনায় মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নৃশংস বোমা হামলায় নিহত উদীচীর নেতা খাজা হায়দার হোসেন ও সুদীপ্তা পাল শেলীর পরিবারের সদস্য এবং ওই ঘটনায় আহত সহযোদ্ধারা। সম্মাননা দেয়া হবে শ্রমিক আন্দোলনের প্রবাদ প্রতিম পুরুষ, জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে। এরপর একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে শেষ হবে। সেখানে শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত উদ্বোধনী আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকবেন উদীচীর উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান খান, বিশিষ্ট নাট্যজন মামুনুর রশিদ, বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং সাহিত্যিক জাকির তালুকদার। এরপর অনুষ্ঠিত হবে সাংগঠনিক নানা অধিবেশন। এছাড়া, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ধারক-বাহক নানা লোক আঙ্গিকের পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে হাজির হবেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
জাতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে উদীচীর ৭১টি সাংগঠনিক জেলার প্রায় সবগুলোর সম্মেলন এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সারাদেশ ও দেশের বাইরে বিস্তৃত উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী সমাজ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে নতুন করে শপথ গ্রহণ করছে। এবারের জাতীয় সম্মেলনে সারাদেশের তিন শতাধিক শাখা থেকে প্রায় এক হাজার পাঁচশত প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক যোগ দেবেন বলে আমরা আশা করছি। নতুন মাত্রার আন্দোলনের পথনির্দেশ করবে ঊনবিংশ জাতীয় সম্মেলন।
প্রিয় বন্ধুগণ,
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বিগত দিনে তার সামগ্রিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অকুন্ঠ সহযোগিতা পেয়েছে। উদীচী আশা করে এই সহযোগিতা আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে। আপনাদেরকে এবং আপনাদের মাধ্যমে জনগণকে আমরা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সম্মেলনের পুরো অনুষ্ঠান আপনাদের স্ব স্ব গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করে সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত প্রগতিশীল, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলায় সহযোগিতা করবেন- এই প্রত্যাশা করি। যত বাধা বিঘœই আসুক না কেন, সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে উদীচীর সংগ্রাম চলছে, চলবেই।
ধন্যবাদসহ-
প্রবীর সরদার
সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সংসদ
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
তারিখ:২৪-১২-২০১৪